বাংলা সাহিত্যে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট / বাংলা সাহিত্য ও উত্তরবঙ্গ / বাংলা সাহিত্যে উত্তর বঙ্গের লোকসমাজ

              বাংলা সাহিত্যে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট 
                                        অথবা 
                   বাংলা সাহিত্য ও উত্তরবঙ্গ 
                                   অথবা 
      বাংলা সাহিত্যে উত্তর বঙ্গের লোকসমাজ 

    

বাংলা সাহিত্যে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট /  বাংলা সাহিত্য ও উত্তরবঙ্গ  /      বাংলা সাহিত্যে উত্তর বঙ্গের লোকসমাজ
বাংলা সাহিত্যে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট

               


        উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে থেকে বাংলা উপন্যাসের দজয়যাত্রা শুরু হয়।কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বাংলা উপন্যাস তার বিচরণ ক্ষেত্র বুহুদুর প্রসারিত করেও উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাসের সংখ্যা খুবই নগণ্য।তবু বাংলা সাহিত্য ও বাংলা উপন্যাসকে উত্তরবঙ্গ নানাভাবে পোস্ট করেছে। উত্তরবঙ্গের ভৌগলিক পরিস্থিতি এখানকার অর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থা , উত্তরবঙ্গের লোকসমাজ এবং তাদের বিশিষ্ট সংস্কৃতি বাংলা উপন্যাসকে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।


        অবিভক্ত বাংলার উত্তরভাগ বিশেষত বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের আটটি জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর-দিনাজপুর রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চল নিয়েই  উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান।এই উত্তরবঙ্গের পাহাড়ের পাদদেশে তথা ডুয়ার্স অঞ্চলে চা বাগান ও অরণ্য অঞ্চল যেমন আছে, তেমনি আছে ছোট-বড় নদনদী, তাদের চর উর্বর সমভূমি এবং নানা মাটির দেশ বরেন্দ্র-ভূমি।তাই বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ও ভাষা উপভাষা অধ্যুষিত অপূর্ব সাহিত্যধারা এখানে লক্ষ্য করা যায়।

    

               উত্তরবঙ্গের পটভূমিকায় রচিত মঙ্গল কাব্যের মধ্যে  এখানকার গোঁসানী মঙ্গল লোকসমাজের পরিচায়নে বিশিষ্ট। কবি রাধাকৃষ্ণদাস বৈরাগী রচিত কাম্তারাজ কান্তেশ্বর এর এর জীবন বৃত্তান্ত সম্বন্ধে এই গ্রন্থে আমাদের প্রাথমিক ধারণা দেয়।কবি তন্ত্র বিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষাল উত্তরবঙ্গের মনসামঙ্গলের বিশিষ্ট কবি। কবি জীবনকৃষ্ণ মৈত্র অষ্টাদশ শতকের রংপুরের কবি শ্রী কোমললোচন 'চন্ডিকবিজয়' নামে কাব্য রচনা করেন।এই সব রচনা গুলির মধ্যে মধ্যযুগের উত্তরবঙ্গের লোকসমাজ ও তখনকার বিশিষ্ট রাজনৈতিক-সামাজিক অবস্থার কথা ফুটে উঠেছে।


  আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতেও উত্তরবঙ্গের ভুমিকা কম নয়। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠে যে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কথা আছে তার ঐতিহাসিক পটভূমি উত্তরবঙ্গ। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে থেকে পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে উত্তরবঙ্গের নানান স্থানে সন্ন্যাসীর উপদ্রব করে বেড়াতো। পলি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের অসুবিধা হতো। এর পরিণতি হিসেবে উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী সঙ্গে ইংরেজদের দস্যুদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরানীতে এই ঐতিহাসিক পট ব্যবহৃত।উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদী এই উপন্যাসে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানীর বিচরণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।ফলে এখানে রয়েছে উত্তরবঙ্গের লোকসমাজের পরিচয়।নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'লালমাটি' উত্তরবঙ্গের মালদা জেলার বামপন্থী কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত।মালদার যথার্থ লোকসমাজের চিত্র, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের ছবি এখানে সুলভ।এরই পাশাপাশি জিতু সাঁওতালের আন্দোলনের(১৯২৪-৩২) স্পর্শ লালমাটিতে আছে। বারেন্দ্রভূমি কৃষক, উপজাতি ও শ্রমজীবী মানুষেরা অত্যাচারি যোতদারদের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল উপন্যাসটির রয়েছে তার পরিচয়।


 উত্তরবঙ্গের জন্য জীবনের সার্থক রূপকার অমিয়ভূষণ মজুমদার তার ' গড় শ্রীখন্ড '- এ উপন্যাসে ১৯৪২-৪৭ সালের মধ্যে দুর্ভিক্ষ দাঙ্গা ও দেশভাগের প্রেক্ষাপটে ছিন্নমূল মানুষের জীবনযাত্রা ও দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন।


  সমরেশ বসুর 'মহাকালের রথের ঘোড়া' নকশাল আন্দোলনের পটভূমি কার লেখা।নকশালবাড়ির কৃষকদের মুক্ত এলাকা গঠন, কৃষক জোতদার সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে নকশাল আন্দোলনের বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে।কৃষকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম এবং চিরকালের বঞ্চিত প্রান্তিক চাষীদের জীবন চিত্র এখানে ধরা পড়েছে।


 সমরেশ মজুমদারের লেখা 'উত্তরাধিকার' জলপাইগুড়ি শহর ও ডুয়ার্সের চা বাগানের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস। স্বাধীনতার পর থেকে জলপাইগুড়ি শহরে রাজনীতির নানা দিক পরিবর্তন বামপন্থী আন্দোলনের বিকাশ ও চা শ্রমিক ইউনিয়ন সৃষ্টি প্রভৃতি এখানে আছে। উত্তরবঙ্গের চা বাগিচার শ্রমিকদের জীবন, তাদের বঞ্চনার ইতিহাস, বামপন্থী আন্দোলনের সূত্রে তাদের অধিকার সচেতন করে তোলা প্রভৃতি উপন্যাসটিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।


দেবেশ রায়ের লেখা 'তিস্তাপারের' বৃত্তান্ত একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তিস্তা নদী, তিস্তা পারের জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার ধারাবাহিকতার সঙ্গে সঙ্গে বয়ে চলেছে। এই উপন্যাসের সময়কাল গৃহীত হয়েছে বিংশ শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত। এই সময় সীমার মধ্যে উত্তরবঙ্গের অর্থ সামাজিক অবস্থাকে লেখক অসাধারণ দক্ষতা তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের প্রধান, অপ্রধান আনুষাঙ্গিক চরিত্র গুলির কার্যকলাপ তাদের বিবর্তন ও জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে উত্তরবঙ্গের তৎকালীন ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটটি বিশ্লেষণমূলক ও তথ্যমূলক আলোচনার মাধ্যমে উঠে এসেছে।


বাংলা সাহিত্যে উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট কোথাকার হলেন অভিজিৎ সেন। উত্তরবঙ্গের একটি বিশেষ অঞ্চলের (মালদা উত্তর দিনাজপুর) জনজীবনের  পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিচয়, সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশেে, মানুষের মুখের ভাষা, আঞ্চলিক ইতিহাস, আদিবাসী সমাজের বিশ্বাস সংস্কার-এককথায় উত্তরবঙ্গের জনজীবন ও সংস্কৃতির  অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ পুরিচয় তার কথা সাহিত্যের রূপ পেয়েছে । এখানকার যাযাবর শ্রেণীর জীবন নিয়ে লেখা তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'রহুচন্ডালের হাড়়' ।মহাকাব্যধর্মী এই উপন্যাসে দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদার কিছু অংশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি উঠে এসেছে ওই সব সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও পুরুষানুক্রমিক কঠোর সংগ্রাম । 


বাংলা উপন্যাসে উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপট ও লোকজীবনের ছবি প্রথম থেকেই বিশিষ্টতা সহকারে উপস্তিত হয়েছে। যদিও বাংলা উপন্যাসের সার্বিক পরিচয় এর মধ্যে এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা খুবই সামান্য, তবুও বেশ কিছু উপন্যাসে উত্তরবঙ্গের জনজীবন, ও তার সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে । উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতিতে নানা বৈচিত্র্য আছে । পারস্পারিক সহাবস্থানের জন্য এখানে জন্ম নিয়েছে এক মিশ্র সংস্কৃতিক (composite culture) । তাই কয়েকটি উপন্যাস ছাড়া উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট লোকজীবনের পরিচয় বাংলা কথাসাহিত্যে কয়েকটি স্থান পায়নি ।

Post a Comment

0 Comments