'আরণ্যক' উপন্যাসে প্রকৃতি অন্যতম বিষয় হলেও এখানে মানুষ উপেক্ষিত নয় ৷
 |
'আরণ্যক' উপন্যাসে |
বিভূতিভূষণ 'আরণ্যক' উপন্যাসে স্বীকার করছেন- 'শুধু বনোপ্রান্তর নয়' কত ধরনের মানুষ দেখিয়াছিলাম' | এই উপন্যাসে ইঁহাদেরই কথাবলিব ' - বলে লেখক প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ছিলেন। সুতরাং
' আরণ্যক ' নিছক প্রকৃতির গল্প নয়, মানুষেরও গল্প। বাংলা উপন্যাসের ' কালান্তর ' গ্রন্থে সমালোচক সরোচ বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন - '' এখানে অরণ্য পর্ব যত আমাদের অভিভূত করুক - লেখকের মূল লক্ষ্য ছিল পাঠক বিবৃত মানুষ ৷ ''
'আরন্যক ' উপন্যাসের মানুষগুলি বাস্তব সামাজিক ঘাত-প্রাতঘাতের মানুষ নয় ৷ আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে , এখানকার চরিত্রগুলি
সমাজ সর্ম্পক রহিত। রাজু পাঁড়ে, যুগল প্রসাদ , মঞ্চী এবং কুন্তা - এদের মধ্যে কোন সামাজিক সর্ম্পক নেই ৷ ধাওতাল সাহুকেও আদর্শ মহাজন বলে মনে হয়না ৷ আসলে লবটুলিয়া বৈইহারের অরন্য জীবন তখনো কোন সংঘটিত সমাজ নেই, কৃষি অর্থনীতি সবে জট বাঁধতে শুরু করেছে। তাই 'আরণ্যক' উপন্যাসের চরিত্রগুলি সমাজ সর্ম্পকের প্রচলিত ধারনা দিয়ে বিচার করা ঠিক হবেনা ৷
এই উপন্যাসে বিচিত্র ধরনের মানুষের সমাবেশ ঘটেছে ৷ এদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজনকে এই আলোচনায় আনা সম্ভব।
অনার্য রাজা দোররু পান্না :- অনার্য রাজা দোবরু পান্না এই অরণ্যভূমির আত্মা, সে এই উপন্যাসেরও আত্মা বটে। মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে দুর প্রত্যন্ত জঙ্গল বৃষ্টিত এক অরণ্য ভূ -ভাগের শেষ রাজ প্রতিনিধী দোবরু পান্না | রাজত্ব না থাকলে সবাই তাকে রাজা বলে মনে ৷ রাজা দোবরু পান্নার সরলতা, অন্ত্যরঙ্গতা অরন্য প্রকৃতির মতোই সহজ সরল ও ত্বতঃফূর্ত ৷ তার অতির্থ গ্রহণের অনুরোধ কথক সত্যচরণ এড়াতে পারেনি ৷ অতির্থের উপকরন সামান্য হলেও রাজার আন্তরিকতা ও সরলতায় তা অসমান্য হয়ে ওঠে ৷ রাজা দোবরু পান্না সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ৷ সভ্য জগৎ ও বাইরের পৃথিবী সর্ম্পকে উঠে আসে এই রাজবংশের গৌরবজ্জ্বল অতীত - 'এই পাহাড়- জঙ্গল সারা পৃথিবী আমাদের রাজ্য ছিল ' ঐতিহ্য ও বংশমর্যাদাবোধের গড়িমা আজোও রাজা দোবরু পান্না কে তাড়িত করে ৷ তাই বংশ মর্যাদা মেনে তিনি এখনো কৃষি কাজ কে জীবীকা হিসাবে গ্রহন করেননি। একদা সাওতাল বিদ্রোহের এই নেতা , এই বিরাট অরণ্য ভূ-ভাগের অধীশ্বর দোবরু পান্না আজ যেন ইতিহাসের ট্রাজেডির নায়ক ৷ তার ব্যক্তিত্ব আত্মমর্যাদাবোধ, সারল্য এবং অতিথেয়তা আমাদের মুদ্ধ করে।
ধাওতাল সাহু :- নওগাছিয়ার বৃৃৃদ্ধ মহাজন ধাওতাল সাহু লক্ষপতি মহাজন । তাকে কালাইয়ের ছাতু খেতে দেখে লেখক সত্যাচরন বিস্ময় হয়েছেন । ধাওতাল কুদীসজীবী, কিন্তু সে উদার আড়ম্বরহীন এবং সে বিশ্বাসী ব্যাক্তি । সমালোচক সরোচ বন্ধোপাধ্যায়ের কথায় -' এ ধরনের গ্রামীণ মহাজন আমরা দেখিনি - বাংলা উপন্যাস তো নোয়ই '। ধাওতাল আত্যন্ত নিরীহ শান্ত প্রকৃতির মানুষ । কত লোক তার কাছ থকে টাকা ধার নিয়ে শোধ করেনি। পনেরো -ষোল হাজার টাকার দুলিল ঠিক মতো সময়ে নালিশ না করায় তামাদি হয়ে গেছে। সেগুলো আম্লান বদনে ছিরে ফেলতে তার এতটুকু দ্বিধা হয় না। লেখক তার মধ্যে নিস্পৃহ, অচঞ্চল এক দার্শনিককে প্রত্যক্ষ করেন। একবার ম্যানেজার বাবুরও এস্টেটর জন্য বিনা কাগজ তার কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ঋণ পেয়েছিলেন।
রাজু পাঁড়ে :- ধরমপুর পরগনার রাজু পাঁড়েকে লেখক বিনা মুল্যে দু-বিঘা জুমি লবটুলিয়া বইহারের উত্তরে বন্দোবস্ত করে দেন। পঞ্চান্ন ছাপান্ন বয়সি এই সুপুরুষ ব্রাহ্মণটি আত্যন্ত দরিদ্র। কাচা শালপাতায় চিনার বীজিই-ই তার খাদ্য। সে রাধা কৃষ্ণের ভক্ত সারাদিন পূজাঅর্চনায় তাঁর দিন কাটে। লাজুক প্রকৃতির এই মানুষটি সামান্য সংস্কৃত যানে কবিতা লেখারও তাঁর অভ্যাস আছে। ধরমপুরের পরিবার পরিজনদের খাওয়ানোর জন্যই সে এখানে জুমি নিয়ে চাষাবাদ করেন।
ধাতুরিয়া :- বারো তেরো বছরের ধাতুরিয়া যাত্রা দলের কাজ করে। কৃষ্ণঠাকুরের মতো দেখতে । মাথায় ঝাকড়া ঝাকড়া চুল, সুন্দর চোখ মুখ, কুচ্কুচে কালো গায়ের রঙ। পায়ে ঘুঙ্গুর বেঁধে সে নাচে, মিষ্টি শুরে গান গায়। ধাতুরিয়ার মধ্যে প্রকৃত শিল্পীর নিস্পৃহতা আছে। সংসারে তাঁর কেই নেই। যাত্রার দল তাকে প্রায় কিছুই দেয়না, শুধু চিনা ঘাসের দানা আর নুন তাঁর নিত্যদিনের খাদ্য, গয়া জেলার ভিটল দাসের কাছ থেকে সে বুহু কষ্ঠে ছক্কর নাচ শিখেছে। এই নির্লোভ কিশোর শিল্পীটি একদিন আত্মহত্যা করে।
যুগল প্রসাদ ঃ- একখেয়ালি বাতিকগ্যস্ত উদ্ভিদতত্ববিদ এই যুগল প্রসাদ দূরদূরান্ত থেকে সে ফুলগাছের বীজ এনে জঙ্গলে লাগায়, অরন্যের সভাবর্ধন করে। এটাই তাঁর নেশা
। লবটুলিয়ার অরন্যের অধিকাংশ ফুলগাছই তারি হাতে লাগানো । সে অত্যন্ত দরিদ্র হলেও সুন্দর্যের পূজারী।
গনোওয়ারী তেওয়ারী ঃ- গনোওয়ারী তিরিশ বত্রিশ বছর বয়সী ব্রাহ্মন চরিত্ত। শ্যাম বর্নের দোহা চাহারা, মাথায় বড়ো চুল, কপালে ফোটা কাটা এই চরিত্তটি ফুলকিয়া বইহারের জঙ্গলের গ্রামে গ্রামে গৃহস্ত বাড়িতে সে পূজা করে । কখনও বা গ্রামের পাঠশালায় মাস্টারি করে। এই জঙ্গলে মহিষ পালকদের বাথানে সে এখন ভিক্ষা করে।
মুটুকনাথ ঃ- ব্রাহ্মন পণ্ডিত মুটুকনাথ নিত্যান্ত সহজ, সরল ও নির্বোদ। লেখক তাকে একটি টোল খুলে দিলেও সেখানে পুডুয়াদের অভাবে টোল বন্ধ হয়ে যায় ।
' আরন্যক' উপন্যাসে নারী চরিত্তগুলির মধ্যে ভানুমুতী, কুন্তা ও মুঞ্চীর ভুমিকা নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন।
ভানুমতীঃ- ভানুমুতী রাজা দোবরু পান্নার নাতির মেয়ে , বয়স ষোল সতেরো বছর সে লাবন্যময়ী সুশ্রী, যৌবনবতী এবং সরল আত্মমর্যাদা জ্ঞান সম্পন্ন । স্নিগ্ধ সারল্য এবং চারিত্রিক লাবন্যে সে কথক সত্যচরনের মন হরন করেছে। সত্যচরন অনেকবার তারই আকর্ষণে দোবরু পান্নার বাড়িতে গেছেন । সত্যচরন তাঁর মধ্যে অদিম নারী প্রকৃতিকে দেখেছন, যার মন সভ্য সমাজের সংস্কারের চাপে পীড়িত নয় । অরন্য ভূমি ত্যাগ করে আসার সময় বিষন্ন সত্যচরনের মনে হয়েছে - " এখানেই যুদি থাকিতে পারিতাম ; ভানুমতীরে বিবাহ করিতাম ... কী হইবে উন্নতি করিয়া ?" অরন্য জীবন থেকে বিদায় লগ্নে ভানুমতীর জন্য লেখকের মন বিষাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
কুন্তা ঃ- স্নেহ মমতা মাখানো এক করুন চরিত্ত কুন্তা। সে বাইজীর মেয়ে এই অঞ্চলের ধনী দেবী সিংহ তাকে বিবাহ করে জাতি চুত্য করেছেন । দেবী সিংহ তাকে ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে রেখেছিল। কিন্তু স্বামী অকাল প্রয়ানে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে নিয়ে কুন্তা জীবন দূবিষহ হয়ে পড়ে। দু - ভাতের জন্য সে বৃষ্টিতেও কাছারির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। লেখক তাকে কয়েক বিঘা জুমি বিনা শেলামীতে দিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়েছেন ।
'আরন্যক' উপন্যাসে লেখক -অরন্য প্রকৃতির বিসাল বৃস্তিত পটভূমিকায় অরন্য লালিত মানুষদের চিত্রায়িত করেছে । অরন্য শুধুমাত্র বিক্ষ লতা পশু পাখি নিয়ে নয় , তাঁর স্নেহাঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া অদিম জনগুষ্ঠির আনন্দ-বেদনারও কেন্দ্রভূমি। তাই প্রকৃতি অন্যতম বিষয় হলেও অরন্য উপন্যাসে মানুষ উপেক্ষিত নয়। প্রকৃতি এবং প্রকৃতির কোনে লালিত মানুষ - উভয় মিলেই তাঁর সম্পূর্ণতা। অরন্যকে এরা পরস্পর অবিচ্ছিন্ন, একে আপরের পরিপূরক।
0 Comments