![]() |
জুমিদার দর্পন |
মীর মোশারফ হোসেনের 'জুমিদার দর্পন' নাটকটিতে সমকালীন যে সমাজ ব্যবস্থা প্রতিফলিত, তার আন্যতম বিষয় জুমিদারের প্রজা শোষন এবং পাশবিক নারী লোলুপতা। আলোচ্য নাটকে সেই জলন্ত সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপিত হয়েছে নিরীহ প্রজা আবুমোল্লার সুন্দরী সুতীসাধ্বী স্ত্রী নূরুন্নেহার অপরিমিত রূপ যৌবন।
নাটক নূরুন্নেহার চুরিত্রটি পূর্ন মাত্রায় বিকশিত। সে-ই এই নাটকের কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু। তাকে কেন্দ্র করেই কাহিনীর উন্মেষ,বিকাশ ও পরিনিতি রচিত হয়েছে। নাট্যকার তার হৃদয়ের সমস্ত দরদ ও সহানুভূতি উজাড় করে এই চুরিত্রটি গড়ে তুলেছেন। তার মতো কতশত দরিদ্র কৃষক বধূ, কন্যা রূপ লাবন্যেরে কারনে জুমিদারের লালসার শিকার হয়েছে, পাঠক-দর্শকদের সামনে তা তুলে ধরার জন্যই নাট্যকার 'জুমিদার দর্পন' রচনা করেন। সুন্দরী রুপসী নূরুন্নেহাকে ভোগের উদ্দেশ্যেই জুমিদার হায়ওয়ান আলী নূরুন্নেহার স্বামী আবুমোল্লাকে বিনা দোষে কয়েদ করে শাস্তি দিয়েছেন,কোন প্রলোভনেই নূরুন্নেহাকে বশ করতে না পেরে লোক পাঠিয়ে জোরপূর্বক ধরে এনে জুমিদার ণূরুন্নেহার সতীত্ব নাশ করেছে। জুমিদার অত্যাচারে গর্ভস্থ শিশু সমেত নূরুন্নহার মৃত্য হয়েছে।
নূরুন্নেহার দরিদ্র কৃষক প্রজা আবুমোল্লার সতীসধবী স্ত্রী। আতি কষ্ঠে অর্থাহারে অনাহারে তাদের দিন কাটে। তবু তাদের সংসারে শান্তি বিরাজ করত। শুধুমাত্র একটু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকাই তাদের স্বপ্ন ছিল। নূরুন্নেহার কোলে আলো করে সংসারে নুতুন অতিথি আসবে এই সুখ- স্বপ্নে তারা মুশগুল ছিল। কিন্তু নূরুন্নেহার রূপ যৌবনই তার জীবনে অভিশাপ রুপে দেখা দিলো নিষ্ঠুর নিয়তির ছদ্মবেশ সেই রূপ যৌবন তার জীবনের সমস্ত সুখ-শান্তি ধ্বংস করে দিয়েছে। জমিদারের অত্যাচার এই নিরাপরাধ মেয়েটি প্রান দিয়েছে, তাঁর স্বামী আদালতে সঠিক বিচার পায়নি, উপরন্তু তাদের ভিটেমাটি দখল করে আবুমল্লাকে জমিদার গৃহ ছাড়া করে করেছে। নূরুন্নেহার জীবনের এই কুরুন পরিনতী দেখানোই নাট্যকারের প্রধান উদ্দেশ্য। তাঁর চরিত্রের এই ট্রাজেডির জন্য সে নিজে আতটুকু দায়ী নয়, তাঁর চরিত্রের কোন ভুল ত্রুটির পথ ধরে এই ট্রাজেডি ঘনিয়ে আসেনি। এই ট্রাজেডি ঘনিয়ে এসেছে বাইরে থকে।
সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব কৃষক পরিবারের ব্ধু হয়েও নূরুন্নেহার প্রলোভন বিজয়িনী। জমিদার আড়কাঠি কৃষ্ণমনি তাকে প্রলুব্ধ করার জন্যই অতুল ঐস্বর্য ও সুখের লোভ দেখিয়েছে, কিন্তু সে তা ঘৃনাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁর নারী জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ নারীত্ব ও মাতৃত্ব সে কোন কিছুর বিনিময়েই নষ্ট করতে চায়নি।কৃষ্ণমনি তাকে প্রলোভন দেখিয়ে বলেছে- "তুমি রাজার রাজরানীর মতো সুখে থাকবে। দেখো জুমিদার, সে কি না করতে পারে?...সে যখন পন করেছে , তখন ছাড়বে না, কখনোই তোমায় ছাড়বে না।" আসহায় নূরুন্নেহার ভাগ্য এখানেই নিধাঁরিত হয়ে যায়।
নূরুন্নেহার গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যার সুযোক পায়নি। তার আগেই তাকে বৈঠকখানায় ধরে এনে জোরপূর্বক ধর্ষন করে নির্মম মৃত্যু দান করেছে। নূরুন্নেহার শোচনীয় পরিনতী ও মৃত্যুর জন্য সে নিজে দায়ী নয়। তার রূপ লাবণ্যই - এর জন্য দায়ী। সুতীত্ব হারিয়ে সে বেঁচে থাকতে চায়নি; নিষ্ঠূর নিয়তি তাকে জর করে মৃত্যুর পথে নিয়ে গেছে | গ্রীক ট্রাজেডির নিয়তির মতোই নূরুন্নেহার রূপ যৌবিন তাকে মৃত্যু পরিনতি দান করেছে।
জুমিদার হায়ওয়ান আলী সর্ম্পকে নূরুন্নেহারকে বলেছিল- " ওরা ছাগলের জাত!- পর্যন্ত পার পায় না, তুমি আমি কোন ছার কথা।... যে গতিকে পারে তোমার মাথা খাবেই খাবে।" এই 'ছাগল জাত ' জমিদার শ্রেনীকে নূরুন্নেহার চেনে, কিন্তু বিনা কারনে বিনা দোষে তার এত বড় সর্বনাশ হবে- এটা ভাবতে পারিনি। কিন্তু ক্রমে তার কাছে পরিস্কার হয়ে ওঠে - বিগত মাসাধিক কাল ধরে জমিদার তাকে লাভ করার জন্য কীভাবে প্রলোভনের জাল বিছিয়েছে। নূরুন্নেহার এই উদ্বেক ও শঙ্কা নাট্যকাহিনীতে গভীর ব্যঞ্জনা এনে দিয়েছে | কৃষ্ণমনি তাকে বশ করতে ব্যর্থ হয়ে রাজার কাছে গিয়ে সত্য- মিথ্যার জাল বিস্তার করেছে । ফলে মূহুর্তেই আগ্নিমূর্তি হায়ওয়ান আলী বলেছে-- " মেয়ে মানুষের এত আস্পর্ধা...মেয়ে মানুষের এত হিম্মত।... আমি মোল্লা চাইন, নূরুন্নেহার চাই।" জুমিদার বৈঠকখানায় তার শোচনীয় পরিনাম নূরুন্নেহার কল্পনাও করতে পারনি। জুমিদারের পাশব নারী লোলুপতায় নূরুন্নেহার জীবন অস্তমিত হল।
নূরুন্নেহার এক আদর্শবাদী সতীসাব্ধী নারী চরিত্র। মানুষ্যধর্ম ও নীতিধর্ম তার চরিত্রের প্রধানতম দিক। অন্যায় কারির প্রতি সে ক্ষমাহীন। তাই বিনা দোষে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে আমানুষিক নির্যাতন করাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি।
সামন্ততান্ত্রিক জুমিদারি ব্যবস্থায় ভূমি ও নারী উভয়ই জুমিদারের ভোগের সামগ্রী, যুগ যুগ ধরে এই রীতিই বহমান; 'জমিদার দর্পণ' নাটকে এই র্নিমম সত্যকেই আবার তুলে ধরেছেন । নূরুন্নেহার চরিত্রের মাধ্যমে লেখক এখানেই জমিদারের সেই লালসাকে রূপ দিয়েছে।
অসহায় গ্রাম্য বৃদ্ধ হলেও নূরুন্নেহার চরিত্রের দৃঢতা আছে ,তার আন্তরে আছে প্রতিবাদের আগুন তাই 'আমিরা' যখন বলে জুমিদার 'কী না করতে পারে' তখন নূরুন্নেহারের প্রতিবাদী কন্ঠে ধ্বনিত হয় -- " পারেন বলে কী একেবারে মেরে ফেলবেন ? এই কি জুমিদারের বিচের? জুমিদার বাপের সমান , কোথায় প্রজার ধন প্রান মান রক্ষা করবেন...উল্টে দিনেই ডাকাতি !"
অশিক্ষিত হলেও তাঁর বিচার বুদ্ধি যুক্তিহীন নয়। তাই জুমিদারের দায়িত্ব কর্তব্যবোধ সর্ম্পকে সে সচেতন । কিন্তু হায়ওয়ানর মতো নারী লোলুপ জমিদাররা নিজ দায়িত্ব কর্তব্য ভুলে নারীকে ভোগের সামগ্রী বলে মনে করে। ধর্ষিত হবার পর মৃত্যু পথযাত্রী নূরুন্নেহার কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে বাংলার অসহায় নিপীডিত বধূ-মাতা-কন্যার আন্তরের ফরিয়াদ- ' জমিদার হয়ে এমন কাজ কল্লে ধর্ম্মের দিকে চাইলে না ।' নূরুন্নেহার যানে এই সমাজে সুবিচার নেই। সবেই জমিদারের বশীভূত 'হাকিমের প হাকিম নিই'; তাই সুবিচারও নিই। তাই বিলেতে মহারানী নিকট সে ফরিয়াদ জানায় । যদিও তাঁর কন্ঠ ধ্বনি সেখানে পৌঁছাবে না । তাই খোদা ছাড়া তাঁর ডাকার আর কেউ নেই
0 Comments