' চিত্র ও সংগীত সাহিত্যের প্রধান উপকরণ '- আলোচনা করো।
![]() |
চিত্র ও সংগীত সাহিত্যের প্রধান উপকরণ |
আমাদের সামনে দৃশ্যমান জগৎ প্রসারিত হয়ে আছে। এখানে ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ মুখ্য-গৌন অঙ্গাঙ্গীক ভাবে থাকে। এই জগতে প্রকৃতির কোন পক্ষপাত নেই। কিন্তু সেই জগৎ যখন আমাদের মনে প্রবেস করে, তখন তা রূপান্তরিত হয়। আমাদের নানা অভিজ্ঞতা ও বিচিত্র ভাবের স্পর্শে যা স্থুল বাস্তব তা মানসিক হয়ে উঠে। আমাদের হৃদয়ের বিচিত্র রসে বাইরের জগৎ নতুন রূপ ধারনা করে। আমরা জগতকে আমাদের চেতনার স্পর্শে মানসিক ও মানবিক করে গ্রহন করি।
রবীন্দ্রনাথের মতে, যাদের হৃদয়বৃত্তির জারক রস পর্যাপ্ত নেই, তারা জগতকে স্থুল বস্তু সীমার বাইরে উপলব্দি করতে পারে না। আমাদের সমাজে এমন কিছু লোক আছে যারা জড় প্রকৃতির ; এদের হৃদয়ের কৌতহোল উৎসুক্য খুবেই সীমিত। তাই তারা এই জগতে বাস করেও প্রবাসী। হৃদয়ের সংকীর্ন জানালা দিয় তারা প্রকৃতিকে দখতে পাননা। পক্ষান্তরে অনেক সংবেদনশী, কল্পনাপ্রবন ও সৌভাগ্যবান মানুষ থাকে, যাদের প্রকৃতির জগৎ থেকে প্রতিনিয়ত আমন্ত্রন আসে। এই পৃথিবীতে 'যেথা যার যত উঠে ধ্বনি ' তা তাদের হৃদয়ের বিনায় সাড়া জাগায়। প্রকৃতি অন্তরের আহ্বান তাদের মনে শীহরন সৃষ্টি করে । অতএব ভাবুকের কাছে বাইরের জুটিল রুঢ় জগৎ থেকেও হৃদয়ের মানবিক জগতের আকর্ষন অনেক বেসি। সংবেদনশীল মানব মন যতখানি বাইরের জগতকে আত্মসাৎ করেনীতে পারে, ঠিক ততখানি সত্যেও সে উপলব্ধি করে।
বাইরের জগৎ নানা শুরে কথা বলে, সুন্দর-অসুন্দর, প্রীয় ও অপ্রীয় মিলে এক প্রত্যক্ষ জগতকে দূবোধ্য ও রহস্যময় করে রেখেছে। যে জগৎ বাইরের তা অন্যন্ত পুরাতন, কিন্তু যুগে যুগে কবিদের অনুভুতি ও মনিষার স্পর্সে , হৃদয়ের সংযোগে তা নিত্য নতুন হয়ে কাব্যে ধরা দেয়। তাই জগৎ জীবনের সনাতন স্রোত চিরদিন নতুন হয়ে চলেছে। কিন্তু এই যে মানুষের মনের জগৎ , যা বাস্তব জগতের নবপ্রকাশ বা রূপান্তর, তা বাইরের প্রকাশিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে। আমাদের মনের জগৎ চিরকালেই সৃষ্টি হয়ে চলেছে । কিন্তু তাকে রুপের সীমায় প্রকাশ না করতে পারলে তা হয় অকৃতকার্য। আমরা হৃদয়ে যা গভীর ভাবে অনুভব করি তা প্রকাশ করতে চাই। তাই চিরকালেই সাহিত্য রচনার প্রবল আবেগ মানুষের মধ্যে অনুভূত হয়।
সাহিত্য রচনার সময় দুটি বিষয় প্রধান হয় উঠে । একটি হলো সাহিত্য শ্রোষ্ঠা ও তাঁর হৃদয় দ্বারা জগতকে কতখানি গ্রহন করতে পারছেন, আপরটি হলো তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা ও অনুভূতিকে স্থায়িতে রূপ দিতে পারছেন কী না। কবির কল্পনা যত সার্বভৌম হবে ততই তাঁর রচনার গভীরতা আমাদের আনন্দ দান করে। তাঁর কাব্যে বিশ্বের সীমা লাভ করে আমাদের মনকে স্বচ্ছন্দে বিহারের সুযোক করে দিবে। বাইরের জগৎ কবির মনে আর একটি জগতে রূপান্তরিত হয়। তাই জগতকে এমন ভাবে প্রকাশ করতে হয় , যাতে সে অন্যের হৃদয়ে অনায়াসে সঞ্চারিত হতে পারে। এই হৃদয়ের ভাব অন্যের মনে সঞ্চারিত করার জন্য কিছু কলাকৌশলের সাহায্যের প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ একটি উদাহরণে বলেছেন - " পুরুষের বেশভূষা সাধারণ ও যথার্থ হলেই চলে, কিন্তু পুরুষের মন জয় করার জন্য নারীর সাজ সজ্জায়, আচার-ব্যাবহারে , ভাব - ভঙ্গীতে অনেক আবরন ও রহ্যস থাকা চাই। কারন তাকে হৃদয় দিতে ও হৃদয় আকর্ষন করতে হয়"।
সাহিত্যেও সেরকম নিজেকে সুন্দর রুপে ব্যক্ত করার জন্য অলংকার ও ছন্দের আশ্রয় নেয়। সাহিত্যকে শুধু ব্যক্ত করলেই চলে না, রূপের মধ্যে রুপতিকে, সীমার মধ্যে অসীমকে প্রকাশ করতে হয়। ব্যাচার্থের অতি অর্থতে প্রকাশ করতে চাই বলে সাহিত্যের ভাষা ইঙ্গীতবহ বা প্রতিধ্বনি, ছন্দ ও অলংকার আশ্রয় করে সাহিত্যের মাধূর্য প্রকাশিত হয়।
ভাষার মধ্যে ভাষাতীর্থে প্রকাশ করার জন্য সাহিত্য ও সংগীত এই দুই উপকরনকে গ্রহণ করে থাকে। ভাষায় ভাব প্রকাশ করা যায়না, কিন্তু তা চিত্রে সহজে করা যায়। সাহিত্যের ভাবকে উপমা রুপকের সাহায্যে চিত্রধবনি করে তোলা যায়। বৈষ্ণব কবি 'বলরাম দাস' যখন বলেন - " দেখিবারে আঁখি আঁখি ধায়" -এর মাধ্যমে চিত্তের ব্যাকুলতা রূপ লাভ করে।
সংগীতের মধ্যমে কাব্যের গভীর ভাব ও অনিবচনিয় মাধূর্যকে প্রকাশ করা যায়। সংগীতের শুর ভাব ব্যাকুলতা প্রকাশ করে। তাই চিত্ত হলো কাব্যের দেহ আর সংগীত তাঁর আত্মা। বস্তুত বাইরের প্রকৃতি ও মানব চরিত্র মানুষের মনে সর্বদা যে রূপ সৃষ্ঠি করে চলেছে, যে শুর সৃষ্টি করেছে ভাষায় রচিত সেই চিত্ত ও গানেই হল সাহিত্য।
0 Comments